#ধর্ম_ধর্মনেতা_আদর্শ_এবং_সুবিধাবাদী_আমরা
-Moni Jewel(মণি জুয়েল)
পৃথিবীর আমরা প্রায় সবাই স্বার্থান্বেষী, যখন যেখানে যে/যারা আমাদের পক্ষে কথা বলে, লড়ায় করে কিছুটা হলেও আমাদের পক্ষপাতিত্ব রক্ষা করে তখনই আমরা তাঁর বা তাঁদের অনুগামী বলতে শুরু করি নিজেদের। আমরা শুধু লক্ষ্য করি তাঁদের সাফল্য, প্রেক্ষাপট না ।আর সাফল্য পেলেই তাকে নিয়ে নাচানাচি করি। অনেক গল্প শুরু করি সেই সং্গ্রামীদের নিয়ে যাঁরা কিছুটা(বেশ কিছুটা) সফল হলেন। কিন্তু তাঁর সংগ্রামে সহোযোগিতায় খুব কমজন আমরা থাকি, থেকেছে।
মহাবীর-
ভারতীয় ইতিহাসে একজন মহান মানুষ, জৈন মতাদর্শের কর্তা বলা হয় তাঁকে । তিনি বলতে শুরু করলেন জীব হত্যা মহাপাপ, অহিংসা পরম ধর্ম ইত্যাদি। ঠিক তখনই কিছু ভীতু, বিলাসী, সুযোগসন্ধানী, ধুরন্ধর আমাদের পূর্বপুরুষরা তাঁর দলে সামিল হলেন নাক কান চোখ মাথা বন্ধ রেখে, বুঝে না বুঝে বলতে শুরু করলেন সেই এক কথা। যা আজও চলছে। এখন তো ধারণা করা হয়েই থাকে অহিংসা মানে বীরত্বের প্রকাশ না করে চড় থাপ্পড় খেতে থাকা । কিন্তু ভাবতে যে বিষয়টা বাকী থেকে যায় তা হলো- উনি মহাবীর কেন তাহলে? যেখানে বীরত্ব নেই বীরত্বের প্রকাশ নেই সেখানে বীরদের মাঝে মহান কেন? তাহলে তিনি কি সে নামের উপযুক্ত ? বলা যেতে পারে নামের সাথে মিল নাও থাকতে পারে কাজের। কথাটা হয়তো ঠিক, সাধারণের ক্ষেত্রে, তাই বলে মহাপুরুষের ক্ষেত্রে নয়। যদি নাম ও কাজে মিল না থাকে তাহলে প্রথমেই ফ্লপ তিনি!
কিন্তু না...তিনি আসলেই বীরশ্রেষ্ঠ, মহাবীর । তাই তাঁর আদর্শ হলো অহীংসা । যিনি যখন চরম বীরত্ব হাসিল করতে পারেন তখনই তাঁর ধর্ম হয়ে যায় অহিংসা, যদি তিনি আদর্শ মানুষ । কারণ তিনি লড়বেন কার বিরুদ্ধে? আর যারা বাকী তার সময়কালে তারা সবাই তাঁর চেয়ে কম বলশালী, জ্ঞানী। দুর্বলের সাথে লড়ায়ই হলো হিংসা, সেখানে বীরের কোনও বীরত্ব নেই।
কিন্তু আজকাল সবাই একবাক্যে বলেন - অহিংসা পরম ধর্ম। অনেক উদাহরণ তুলে ধরেন । একদমই ঠিক। তবে আগে বীর হতে হবে তো! কারণ বীরের ধর্ম অহিংসা । আর এই বীরত্ব হাসিল করাটায় হলো সংগ্রাম। নিজের সাথে নিজের, অন্য সবকিছুর সাথ নিজের। এই সংগ্রামে বিজয়ীর ধর্ম হলো অহীংসা, এই বিপ্লবের পরে প্রতিষ্ঠিত হয় অহিংসা । অনেকে বলবেন মহাবীর কি খুব বলশালী ছিলেন না কি? যদি বলা হয় হ্যাঁ তিনি খুব বলশালী ছিলেন তবে অনেকে প্রশ্ন! তাই উত্তরে এ কথা বলা যেতে পারে তিনি যদি বলশালী না ছিলেন তাহলে তার মত(ইজম)সে সময়ে প্রতিষ্ঠা পেলো কি করে, সনাতনী বৈদিক দাপটের সামনে??
সংগ্রাম_জেহাদ_বিপ্লব-
অন্যদিকে জেহাদী স্বর্গে জান্নাতে যাবে বলে প্রচার শুরু করলেন মহম্মদ(সঃ)। শুনে মুসলমানদের কিছু গোষ্ঠী তো এখন শুধু পারলেই মানুষ হত্যা করবে এমন মনের হয়ে গেছে। শুধু এখন নয় প্রায় তার সময় থেকেই! উনি যখন শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে অস্ত্র ধারণ করলেন, সেই সময়ে কিছু কুচক্রীও সামীল হলো এই ভেবে -এবার অস্ত্র নিয়েও ধর্ম হয়! কিন্তু আসলে তারা মহম্মদের আদর্শ থেকে অনেক দুরে চলে গেছে,গেছিলো। যে মানুষটা সারাজীবন লড়ায় করলেন শান্তি অর্থাৎ ইসলাম প্রতিষ্ঠিত করতে সেই মানুষটার মতাদর্শ কেমন করে বর্বর কিছু গোষ্ঠীর মতো হলো বা বর্তমানে কথিত কিছু ইসলামী সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের হয়ে গেলো! এটা বড় ভাবনার বিষয় আজকাল!
কিন্তু যতক্ষণ না আমরা স্থান কাল পাত্র সঠিক নির্বাচন করতে পারবো ততক্ষণ সঠিক সিদ্ধান্তও আমরা গ্রহণ করতে পারবো না, সঠিক ব্যাখ্যাও সম্ভব নয়।
মহম্মদ নবী যে সময় কালে যাদের বিরুদ্ধে লড়ায় করতে বাধ্য হয়েছিলেন, তাঁকে আমাদের ভাবতে হবে সেই সময়ের বিচারে । তিনি যদি তাঁর সময়ে অস্ত্র ধারণ না করতেন তাহলে অশান্তিকেই প্রশ্রয় দেওয়া হতো, সুতরাং তুলনায় অনেক ভালো অস্ত্রে অস্ত্রকে পরাজিত করা, শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য । অশান্তিকে দমন করতে অস্ত্র ধারণ করা অবশ্যই দরকার। ফলে শান্তি সুরক্ষিত হয়। তিনি যদি তখন বিপ্লব না করতেন সংগ্রাম না করতেন তাহলে অবস্থা কল্পনা করা যেতেই পারে কতটা বাজে হতো। কারণ সে সময়ে পৃথিবীর সবচেয়ে মন্দ স্থান ছিলো সেই এলাকা যেখানে মহম্মদ নবী জন্মগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু আমরা সাধারণরা তা কতটা বুঝে কতটা না বুঝেই নিজের মন মতো আলফাল বলে যাই! অনেক অল্প-শিক্ষিত আমারা এ নিয়ে অনেক বাজে মন্তব্যও করে থাকি! এ ভুল ব্যাখাতেও আমারাই দায়ী। সত্য সঠিকভাবে তুলে ধরতে পারি না, উপস্থাপন করতে পারি নি।
আর এগুলো হলো সুযোগসন্ধানী আমাদের পূর্বপুরুষদের ফালতু মানসিকতার কারণে । তারা সংগ্রাম না দেখে শুধু দেখেছিলেন সংগ্রামের ফলাফল। যখনই মনে হয়েছে পক্ষের কেউ আমাদের হয়ে কথা বলতে বলতে সংগ্রাম করতে করতে আজ সাফল্যের চরমে তখনই সুযোগসুবিধা পেতে দলে গিয়ে নাম লিখিয়ে, তারপর -অপব্যাখ্যা ব্যাখা যাচ্ছেতাই ।
মহাভারতের যুদ্ধের কথা এখানে একটু বলা দরকার - যে কৃষ্ণকে আমরা জানি প্রেমের প্রতীক, কোমল হৃদয় যার, তিনি কিভাবে অর্জুনকে যুদ্ধ করতে তাগিদ দেন! এখানে আমাদের ভাবতে হবে । তিনি তো ভীমকে বলতে পারতেন যুদ্ধ করতে। তা না করে কেন অর্জুনকে বললেন? যে অর্জুন রাজী হচ্ছেন না! কারণ তিনি জানতেন মন্দের বিরুদ্ধে এমন একজন কোমল হৃদয় ভালমানুষ অস্ত্রধারীর দরকার যে শুধু অশান্তির কারণে শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে অস্ত্র ধরবে। আর এটাই আসলে চরম প্রেমের প্রকাশ । কিন্তু যদি ভিমকে আদেশ করতেন যুদ্ধ করতে তাহলে হয়তো চিত্র অন্য হতো, খুব মন্দ হতো ।
আমরা যে আসলে সংগ্রাম বিমুখ, শুধু সংগ্রামের ফলে উদ্ধার হওয়া সুযোগ সুবিধার দিকেই বেশীরভাগ দেখি, এবং যুগে যুগে তত্ত্বের অপব্যাখ্যা করে নিজের মন মতো করে থাকে। তার প্রমাণ আজও জ্বলন্ত!
অন্যদিকে-
কয়দিন আগে একজন বিখ্যাত সংগ্রামী মানুষের মৃত্যু হলো। ওনার নাম ফিদেল কাস্ত্র । অনেক আলাপ আলোচনা সভা ইত্যাদি ইত্যাদি হলো । হওয়া অবশ্যই দরকার। খুব খুব দরকার। কিন্তু একটু ভাবলেই ছেদ পড়ে আসলে মুখে মুখে যে এতো এতো সংগ্রাম তাহলে 'আমরা_বক্তাদের' জীবন কতটা সংগ্রামী? আসলে তা নয়, এখানেও মহান ওনার সংগ্রামের ফলে অর্জিত সুযোগ সুবিধাগুলোর জন্য ওকে নিয়ে নাড়া ঘাটা, তা ছাড়া সাধারণত আর কিছুই না! (তবে সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য না) ।
বহু দল বামপন্থীদের তাঁরা সবাই মহান কাস্ত্রোর কথা ওড়ালেও জীবনে এবং রাজনীতিতে কতটা প্রয়োগ করেন তা বড় ভাবার বিষয়।
আর যদি সংগ্রামী মানুষের কারণেই যদি আমরা তাঁকে অনুসরণ করতাম তাহলে আমাদের এক মনোভাব কোথায়?
আসলে সুযোগসন্ধানী আমরা যখনই একজন সংগ্রামী প্রতিষ্ঠিত বীরের সন্ধান পাই তখনই আপন স্বার্থে তোষামোদ শুরু করি! মুখে হাজার বললেও তা তাঁকে অনুসরণ নয়(বেশিরভাগ),আসলে তার প্রতিষ্ঠিত সুখের লালসা!
যদি সংগ্রামকেই জীবনে প্রয়োগ করার জন্য একজন আদর্শ লোক মনে করি তাহলে এই ভুখন্ডেরই একজন মহান শিবদাস ঘোষ কে কয়জন জীবনে প্রয়োগ করার চেষ্টা করি?(পক্ষপাতিত্ব করছি না, তুলনাও না) ।তুলনায় খুব কমজন তাঁকে চেনেন!
কাস্ত্র অবশ্যই মহান কিন্তু তাকে এখানে এ'দেশে প্রয়োগ করতে হলে অনেক সমস্যা, কারণ তাঁর স্থান পাত্র আলাদা । তিনি তার স্থানের সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করেছেন, এবং কিছুটা সফল হয়েছেন ।
কিন্তু শিবদাস ঘোষ, যিনি এই উপমহাদেশের একজন মহান চিন্তাবিদ, দার্শনিক, বিপ্লবী । কৈ তাকে নিয়ে এমন সমারোহ লক্ষ্য করি না!? অথচ সন্দেহের উর্ধ্বে তিনি বর্তমানেও বামপন্থী আদর্শ হতেই পারেন উপমহাদেশের ।
আমরা যদি আসলেই সংগ্রামী মনের হতাম তবে হয়তো হতো কিন্তু তা নই আমরা(সাধারণত)। আসলে সংগ্রামের ফলে সুযোগ সুবিধার জন্যই কিছু গ্রহণ এবং বর্জন করে থাকি । সেই সংগ্রামকে নয়!
আমরা সেদিনই তাঁদের অনুসারী বলতে পারবো নিজেদের যেদিন আমরাও স্থান-কাল-পাত্রের বিচারে সিদ্ধান্ত নিয়ে সংগ্রাম করবো বৃহত্তর স্বার্থে। একমাত্র সেদিনই নিজেকে বলতে পারবো তাঁদের আমরা অনুসারী।।
(আলোচনায় অনেককিছু বাকী থেকে গেলো । ভুলভ্রান্তি থাকলে পাঠক-পাঠিকা ক্ষমা করবেন)
।।19.12.16/01:40দুপুর/ধুলিয়ান।।
No comments:
Post a Comment