ব্যক্তি_নিরপেক্ষতা_মানুষ_এবং_ধর্ম
-Moni Jewel(মণি জুয়েল)
সবাই যখন ধর্মনিরপেক্ষতা, মানবতাবাদ, ব্যক্তি স্বাধীনতা, ব্যক্তি চিন্তা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে কথা বলেন, আলাপ আলোচনা করেন তখন আমার মনে এই প্রশ্নগুলো জাগে- ব্যক্তি কে? ব্যক্তিত্ব কি? ধর্ম কি? ধার্মিক কারা? মানুষ কাদের বলা যায়?
বিশেষ জ্ঞানী মানুষরা বলেছেন -মানুষের পেট থেকে জন্মগ্রহণ করলেই মানুষ হওয়া যায় না। আমাদের বাংলার কথাসাহিত্যিক শরৎবাবুও তা বলেছেন আরো একটি কথা যোগ করে, তা হলো এমন প্রায় - পশুর পেট থেকে জন্মালে পশু হয়, কিন্তু মানুষের পেট থেকে জন্মালেই মানুষ হওয়া যায় না।
তাহলে মানুষ কাদের বলা যাবে? না...মানুষ হতে হলে মনুষ্যত্ব অর্জন করতে হবে। কি ভাবে আমরা মনুষ্যত্ব অর্জন করবো? এর পথ কি, সিস্টেম কি? কেউ বলেন গুরু সঙ্গ নিতে হবে, কেউ বলেন আদর্শ ব্যক্তিত্বদের অনুসরণ করতে হবে ইত্যাদি।
অনুসরণ.....
অনুসরণ কথাটার মানে আমরা অল্প শিক্ষিতরা সাধারণত মনে করে থাকি - কোনও বা কিছু আদর্শ ব্যক্তির মত এবং পথকে নিজের জীবনে নকল করা(চেষ্টা করা)। যে পথে তাঁরা যেভাবে এগিয়েছেন সেভাবে তা তা করা, তাহলেই অনুসরণ হয়। ফলে পুণ্য হয়, কারো মতে জীবনের মান ভালো হয়, আরো কারোদের মতে বিপ্লবের পথ সুগম হয়।
বিপ্লব......
এই বিপ্লব শব্দটা আমাদের সময়ে খুব বলা হচ্ছে, বিশেষত বামপন্থী মনের মানুষরা তুলনায় বেশীই বলেন। মন্দ না । অবশ্যই বিপ্লবী মন গড়া দরকার সকলের। তাহলে বিপ্লব কথাটা কি? এর অর্থ কি? না.... বিপ্লব কথাটার অর্থ হলো আমুল পরিবর্তন। তাহলে আমরা আমুল পরিবর্তন করবো কি স্টাইলে? তার সিন্ট্যাক্স কি?
বিন্যাস হলো - নিজেকে যা কিছু সবই বাদ দিয়ে নতুন কিছুকে সৃষ্টি করা মুক্ত চিন্তার মাধ্যমে এবং তার প্রয়োগ করা জীবন ও সমাজ জীবনে।
আর এই বিপ্লবের জন্য সবচেয়ে বড় যে জিনিসটার দরকার হয় তা হলো ব্যক্তি এবং ব্যক্তিত্বের। আর ব্যক্তিত্ব সৃষ্টি হয় স্বাধীন চিন্তার সাহায্যে।
কিন্তু সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো যাকে আমরা ব্যক্তি বলি, ভাবি তা আসলে ব্যক্তি নয়। আমাদের খুব কম জনের ব্যক্তিত্ব আছে, আমরা আসলে অনেকেই ব্যক্তি নই, ব্যক্তিত্ব নেই!
ব্যক্তি হয়ে আমরা সবাই জন্মালেও বড় হতে না হতেই আমাদের ব্যক্তিত্ব শেষ হতে থাকে। প্রথমে বাবা মা আত্মিয় স্বজনের নানাবিধ শিক্ষার চাপে! পরবর্তীতে সমাজের চাপে। কথাটা শুনতেলএকটু মন্দ ঠেকলেও এটাই সত্যি। কথা উঠবে তাহলে সন্তানকে সুশিক্ষা দেবো না???
এই যে সুশিক্ষা কথাটা এটা আমাদের কে নির্ধারণ করে দিলে? কিসের ভিত্তিতে ভালো মন্দ নির্ধারণ করা হলো? মুসলিম রা যা কুসংস্কার বলে তা-ই অন্যদের সংস্কার, আবার মুসলিমরা যা সংস্কার মনে করে তা আবার অন্যরা সমালোচনা করে। এভাবে স্থান কাল পাত্রের বদলে সু হয় কখনো কু কখনও সু। আসলে কু কিছুই না সবই সু, সময়ের বদলে যাওয়া মাত্র ।অন্যদিকে দৃষ্টিকোণের পার্থক্যও।
(সে আলোচনা পরে করা যেতে পারে আরো বিস্তারিত ) ।
একটা শিশু যখন বড় হলো তখনই তাকে শিখিয়ে দেওয়া হলো - মসজিদ, মন্দির, গির্জা, হিন্দু, মুসলিম, খৃষ্টান, ইহুদি, কমিউনিস্ট(সাধারণত বয়সে একটু বড় হলে)! তারপরে জাত ধর্ম দেশ গোত্র ইত্যাদি। আর এভাবেই মৃত্যু শুরু হলো ব্যক্তির। পরে যা গড়ে উঠলো তা হলো সমাজের রেওয়াজের সমষ্টি। যার আর কোনো ব্যক্তিত্ব নেই! বাবা মা সমাজ যে কতবড় শত্রু একজন সন্তানের তা ভাবা দরকার। কিন্তু কাউকে সরাসরি দোষ দেওয়া ঠিক হবে না, এক্ষেত্রে।
যার ব্যক্তিত্ব নেই তার ব্যক্তিগত চিন্তাও থাকার কথা না, এবং সে-তারা-আমরা যতই বলি না কেন-স্বাধীনতা, তা আসলে পরাধীনতা। যা আমরা নিজেরাও জানি না! আমাদের অজান্তেই আমরা পরাধীন।
আর যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা পরাধীন ততক্ষণ আমরা মনুষ্যত্ব হাসিল করতে পারি নি। মনুষ্যত্ব হাসিল করার আগে আমরা যতই ওমুক বাদ তমুক বাদ(ইজম) বলি, সবই ফাঁকা বুলি মাত্র।
আর এই মনুষ্যত্ব হাসিল করতে যা করতে হয় তা-ই বিপ্লব। নতুন করে প্রকৃত আমি'কে আবিষ্কার করা। তার মানে এই না যে যা কিছু সবই মন্দ প্রচলিত আছে, যা আজও প্রচলিত সময়ের বিচারে তা বর্তমানে কতটা প্রযোজ্য বিষয়গুলো, সেই নতুন গড়ে ওঠা মনের বিচারে আলোচনা সমালোচনার মাধ্যমে গ্রহন এবং বর্জন করতে হবে।
ঠিক এই কাজগুলোয় করে গেছেন আমাদের মহান ব্যক্তিত্ব সকলেই তাঁদের সময়ে।
আমরা বলে থাকি -আমরা তাঁদের অনুসরণ করে থাকি। কিন্তু না আমরা আসলে তাঁদের অনুসরণ করি না। শুধু আমরা সাধারণরা'ই নই যারা বিভিন্ন মতবাদের চর্চা করেন তারাও। খুব খেয়াল করে দেখবো আমরা - তাঁরা কোনও না কোনও মতবাদের পক্ষের । যতক্ষণ আমরা কোনও না কোনও পক্ষের ততক্ষণ স্বাভাবিকভাবেই নিরপেক্ষ নয়।
আর নিরপেক্ষ না হলে ব্যক্তি কথাটা হাস্যকর মাত্র, ব্যক্তি চিন্তা আরো বড় উপহাস!
কিন্তু দেখবেন মার্ক্স একজন ব্যক্তি যাঁর ব্যক্তিত্ব আছে, মহম্মদ একজন ব্যক্তি যাঁর ব্যক্তিত্ব আছে, যিশু, কনফুসিয়াস, লালন, কবির এঁরা ব্যক্তি যাঁদের আপন আপন ব্যক্তিত্ব আছে। কিন্তু কথিত তাঁদের অনুসারীদের ব্যক্তিত্ব নেই।
আসলে যারা মনে করে তারা একেকজনের অনুসারী তাদের বড়জোর বলা যায় অনুকরণের চেষ্টাকারী।
কারণ অনুসরণ মানে কপি নয়, অনুসরণ মানে তারা যেমন ঘাত প্রতিঘাতের মাধ্যমে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন, ধরণের রকমফেরে স্থান-কাল-পাত্রের বদলে তেমন উন্নতস্থানে নিজেকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হলো- অনুসরণ করা।
কিন্তু আমরা প্রায়ই অন্ধভাবে কারো না অন্ধ অনুগামী।
মার্ক্সবাদের চিন্তা করে এমনরাও মনের অজান্তে প্রচণ্ড অন্ধত্বে জর্জরিত! যা বেশী ভাবায়।
ব্যক্তি হলো তাই যা এক এবং একক, যার আর দুই নেই। তখনই তা হয় একজনের সত্ত্বা এবং তিনিই একজন মানুষ ।
অন্ধ আস্তিকদের মতো অন্ধ বিজ্ঞানমনাও খুব এ্যাভেলেবল, এদের দুইয়ে কোনো তফাৎ তেমন নেই।
বস্তু বস্তু করে বটে কিন্তু বস্তুর ধারণা খুব কমজন ব্যাখ্যা করতে পারেন, ঠিক যেমন আস্তিরা ঈশ্বর ঈশ্ৃর করে কিন্তু বোঝাতে বড়ই অক্ষম। আমরা যখন এক একক হতে পারবো তখনই অনেক সমস্যার সমাধান পাবো, তার আগে নয়। মুক্ত হওয়া ছাড়া কিছুই উদ্ঘাটন সম্ভব নয়। আমরা যতক্ষণ কোনো কিছুতে আবদ্ধ ততক্ষণ মুক্ত চিন্তার অধীকারি নই, আর ধার্মীকও নই। কারণ ধার্মিক তিনিই যিনি এক এবং একক। বাকী সবই অনুসরণকারীও না, অন্ধ অনুকরণের চেষ্টাকারী বা ইচ্ছা পোষণকারী।
(আরো আলোচনা দরকার, বাকীগুলো আপাতত বাকী থাক)
।। 17,12,16/Dhulian ।।