ভাষা নিয়ে আমরা দেখি আমাদের মধ্যে একটা বিশেষ আবেগ আছে। হয়তো সব ভাষার মানুষের মধ্যেই আছে। তারপরও যতদূর দেখেছি বাংলার (উভয়) মানুষদের মধ্যে একটু বেশি, কারণ এই নিয়ে প্রচলিতরাজনৈতিক বড়ো একটা রক্তারক্তি ব্যাপার আছে। যাইহোক.. কখনও কখনও কেউ কেউ সেটা পাকিস্তান বিরোধিতা হিসেবে, উর্দূ বিরোধিতা হিসেবে, হিন্দি বিরোধিতা হিসেবে, কখনও কখনও কেউ কেউ অল্প জেনে মুসলমান বিরোধীতা হিসেবেও ব্যবহার করেন। তাছাড়া এখানে মুসলমান ভাষা হিন্দু ভাষা নিয়ে অনেক কথা আছে, বহু পুরোনো। যাইহোক... মাতৃভাষা নিয়ে আমাদের প্রেম আবেগ দারুণ। কিন্তু সমস্যার কথা হলো মাতৃভাষার ধারণা আমাদের মধ্যে তেমন নেই, থাকলেও চর্চা নেই।
রাজনীতি বিজ্ঞানের ছাত্ররা নির্ভরতা তত্ত্ব, নব্য মার্ক্সীয় নির্ভরতা তত্ত্ব, বিশ্ব ব্যাবস্থা তত্ত্ব ইত্যাদি পড়লে দেখতে পাবেন কোনো গোষ্ঠী কিভাবে নিজেদের এগিয়ে নিয়ে যেতে গিয়ে অন্যদের পিছিয়ে রেখে দেয় অন্যদের এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে। Hans Singer ও Raul Prebish এর নির্ভরতা তত্ত্বের মধ্যে তা পড়তে পাবেন। বিশেষ করে আর্জেন্টিনার অর্থনীতিবিদ প্রেবিশ এর আলোচনায় পড়তে পেয়েছি, যিনি United Nations Commission for Latin America-র সদস্যও। যারা পলিটিক্যাল সাইন্স নিয়ে উচ্চশিক্ষা নিয়েছেন তাঁরা জানেন। প্রেবিশ, উন্নত বিশ্ব ও অনুন্নত বিশ্বের অবস্থার অসাম্য দূরীকরণ ও সমতা আনতে গবেষনা করতে গিয়ে বলেন অনুন্নত বিশ্বের অনুন্নতির জন্য দায়ী উন্নত দেশগুলো ও তাদের ব্যবস্থা। সেই তত্ত্বের মূল বক্তব্য হলো- একটি উন্নত ব্যাবস্থা, কিছু অনুন্নত ব্যাবস্থার বিকাশের সম্ভাবনাকে আঁটকে রাখে এবং ক্ষতিসাধন করে। এটি এমন এক অবস্থা যেখানে অনুন্নত ব্যাবস্থাগুলো, উন্নত ব্যাবস্থাগুলোর উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, এবং তাদের চাবিকাঠি থাকে নিয়ন্ত্রক উন্নত দেশের হাতে। এই উন্নত ব্যাপারটিকে এখন আপনারা মহানগরী বা কেন্দ্র ধরুন। আর অনুন্নত ব্যাপারটিকে প্রান্তিক উপনগরী বা অধিনস্ত অঞ্চল ধরুন। কিম্বা আমির আমিন(নির্ভরতা তত্ত্ব, বিশ্বব্যবস্থা তত্ত্বে এঁকে পড়তে পাবেন)কে ফলো করে আপনারা উন্নতব্যাপারটিকে কেন্দ্র এবং অনুন্নতব্যাপারটিকে প্রান্তিক ধরুন। কারণ তিনি মহানগরী উপনগরী ধারনার বদলে তা'ই করেছেন। এছাড়া বিশ্বব্যবস্থা তত্ত্ব পড়তে গিয়ে কেন্দ্র, অধাপ্রান্ত এবং প্রান্ত এই তিনের ধারণা পাবেন। এখানে কেন্দ্র, আধাপ্রান্ত ও প্রান্তের উপরে যা কিছু নির্ধারণ করে, আবার অধাপ্রান্ত, প্রান্তের উপরে...। যদিও এর সদর্থক দিক আছে বলেই সেই তত্ত্বের অনেক তাত্ত্বিকরা মনে করেন। উদাহরণ হিসেবে তারা বলেন এখানে কেউই স্থির ক্ষমতাবান না, পরিবর্তন সম্ভব, নেদারল্যান্ডের হাত থেকে যেমন UK&USAর হতে ক্ষমতা স্থানান্তরিত হয়েছে।
আপনারা ভাবছেন আমি ভাষা নিয়ে বলতে এসে রাজনীতি কেন লিখছি! না আমি সরাসরি রাজনীতি আলোচনা করছি না, তাই সেসবে বেশি ঢুকিনিও। আমরা জানি, সমস্ত কিছুর পেছনে রাজনীতি থাকে। যাইহোক শিক্ষিত মানুষদের বুঝবার সুবিধার্থে রাজনীতির তত্ত্ব থেকে উপরের কথাগুলো আনলাম। কেন আনলাম পড়া শেষ হলে বুঝে যাবেন। এমনকি পথ নির্দেশও দিতে পারে আরো জানার।
এবার আসি ভাষা নিয়ে। আমরা(বাঙালীরা) মাতৃভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছি একথা ফেব্রুয়ারি এলে আমরা বেশি বেশি করে বলি। কিন্তু আজ পর্যন্ত আমরা আমাদের মাতৃভাষার স্বাধীন চর্চা করতে পাই নি। এ কেমন কথা? হ্যাঁ কথা এমনই। আমাদের প্রা স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটি থেকে শুরু করে যেকোনো অফিসে আপনাকে যে ভাষায় কথা বলতে বাধ্য করা হয় তা আরোপ করা। আমাদের কেন্দ্র(এখানে রাজ্যের কেন্দ্র পড়ুন বা মহানগর পড়ুন) কিছু শিক্ষিত নির্ধারক সম্মানিয় মানুষ মিলে আমাদের যা নির্ধারণ করে দেয় আমরা তা ধারণ করতে বাধ্য থাকি, নিজের মাতৃভাষা হিসেবে। সেই নির্ধারিত ভাষাকে প্রচার করা হয় সুশীল ভাষা হিসেবে, সুসভ্য ভাষা হিসেবে। আমারও তা দেখতে দেখতে শুনতে শুনতে ভাবতে ভাবতে এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছি সম্মোহনের প্রভাবে। আমরা এখন নিজের ভাষায় কথা বলতে লজ্জা পাই। কারণ আমাদের মাতৃভাষা নাকি সুশীল নয়। আমরা নিজেকে উন্নত প্রমাণ করাতে গিয়ে মাতৃভাষা ত্যাগ করে দিয়েছি। আমাদেরই শিক্ষিত সমাজ, হাতে ধরে, আমাদের নিজস্ব ভাষা ভুলিয়ে দিয়েছেন। আসলে তাঁদের উদ্যেশ্য ছিলো আমাদের উন্নত করার। কারণ তাঁরা চেয়েছিলেন ক্ষমতাবান ভাষা শিখিয়ে আমাদেরকে ক্ষমতায় আসিন করতে। ক্ষমতা মানে শুধু রাজনীতি না, চাকুরী বাকুরি ইত্যাদি। তাঁদের আমরা শ্রদ্ধা করবো। এবার দেখুন, আমাদের কেন্দ্রকে আপনারা আধাপ্রান্ত হিসেবে দেখতে পাবেন। ধরুন আপনার কেউ Net/Set exam দেবে, সেখানে সেই পরীক্ষার্থী ভাষা সাবজেক্ট ছাড়া যেকোনো সাবজেক্ট ইংরেজিতে দিতে বাধ্য। এখানে আবার কেন্দ্র হিসেবে ব্রিটিশ ইংলিশ আর আধাকেন্দ্র হিসেবে আমাদের মহানগর। আবার সেই আপনিই দেশের মধ্যেই যখন অন্য প্রান্তে, তখন এই বইয়ের বাংলা ভাষা দিয়েও আপনার কাজ হবে না, আপনাকে হিন্দিতে কথা বলতে জানতে বাধ্য হতে হচ্ছে। এখানে কেন্দ্র ভূমিকা পালন করছে হিন্দি ভাষা। কখনো কখনো ইংরেজি। এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন কেন উপরে সেই রাজনৈতিক তত্ত্ব কথা টেনে এনেছিলাম।
এভাবেই আমরা চিরদিন প্রান্তে থেকে গেছি। প্রান্তে রেখে আমাদের শক্তিকে ব্যবহার করে ক্ষমতাসীনদের স্বার্থ রক্ষা করা হয়েছে আমদের নিজের অস্তিত্ব ভুলিয়ে দিয়ে। এই আমরা যখন উপরে উঠে গেছি তখন নিজেরাই নিজেকে ভুলে গেছি! কিন্তু খেয়াল করুন কেউই কিন্তু জোর করে আমাকে বা আপনাকে এসব করায় নি। ব্যবস্থা এমন যে আপনি আমি বাধ্য হয়ে গেছি। এখন তো অবস্থা এমন যে ক্ষমতাসীন বাংলাভাষাটাও না শিখে ইংরেজি শিখছে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম। যাইহোক... এখানে প্রশ্ন উঠবে সব অঞ্চলের ভাষায় কাজ করলে ব্যাবস্থা কিভাবে চলবে? আমি তার উত্তরে বলি- গবেষনা করে পথ বের করতে হবে। মানুষ যেকোনো পথ সুন্দরভাবে গড়ে নিতে জানে। কিন্তু তার আগে যা দরকার তা হলো নিজস্ব ভাষা সংস্কৃতি নিয়ে জেগে ওঠা। নিজের ভেতরের জাগরণ। নিজের ভাষা সংস্কৃতিকে সম্মানিত ভাবার মানসিকতা। গর্বের সাথে আমাদের নিজের ভাষায় কথা বলতে হবে। আর এটা নিজের ভাষাভাষী এলাকা থেকে শুরু করা দরকার। কিন্তু আমাদের সমাজের মানুষরাই বেশি নাক শীটকে থাকেন নিজেদেরই নিজস্ব ভাষায় কেউ কথা বললে! এ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আপনার প্রাত্যহিক জীবনে চ্যারাক বলা বাদ দিয়ে প্রদীপ বলবেন কেন? গেছিলাম'কে গেছিনু বলতে আপনার লজ্জা লাগবে কেন? কুণ্ঠে না বলে কোথায় বলবেন কেন? বললাম এর স্থানে ক্যহনু বলতে পারবেন না কেন?
কিন্তু, লজ্জা লাগে, বলতে পারা যায় না, পারি না, বা ভুলেও গেছি অনেকে। আজকাল আমরা গোস্ত বলি না, মাংস বলতাম মাঝে কিছুদিন, এখন তো আবার চিকেন মাটন বীফ এগুলো বলি! দেখতে পাচ্ছেন কিভাবে আমাদের উপরে আধিপত্য বিস্তার করে আমাদেরকে ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে আমাদের নিজেদেরকেই? আমি নতুন কিছুকে গ্রহণের বিপক্ষে বলছি না। বলছি নিজেদের ভাষা সংস্কৃতি নিয়ে জেগে থাকতে, নিজেদের ভাষা সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে।
আমরা যারা বাংলা শিল্প সাহিত্য কবিতা নাটক নিয়ে জানতে ভালোবাসি, তারা বাউল শিল্প জানি। বাউল বললে আজকাল শ্রদ্ধেয় বাউল আব্দুল করিমের নাম বেশি শোনা যায়। কি যাদু করিয়া বন্দে মায়া লাগাইছে। আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম। তাঁর গান। তিনি বাংলা ভাষাও নিয়ে গান করছেন। আমরা জেনেছি তিনি বাংলাদেশে উর্দূ ভাষার বিরুদ্ধে বাংলা ভাষার পক্ষে গান গেয়েছেন। আমরা তাঁকে বাউল গায়ক লেখক কবি হিসেবে শ্রদ্ধা করবো। বাংলাদেশ সরকার তাঁকে সম্মানিত করছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত জানতে পারি নি তিনি সিলেটি ভাষা নিয়ে তেমন একই কথা বলেছিলেন কি না! তিনি সিলেটের মানুষ। যদ্দুর জানি সিলেটের নিজস্ব একটা ভাষা আছে, আছে তার বর্ণমালা। এই তথ্য এখনও পাই নি যে, বাংলাদেশের সিলেট বিভাগের সমস্ত সরকারি কাজ সিলেটি ভাষায় হয় কি না। এমন তথ্য না পাওয়া হয়তো আমারই সীমাবদ্ধতা। তবে যা জেনেছি বাংলাদেশের আইনি কাজ(কোর্টের রায়) ইংরেজিতে হয়। যাইহোক... তারপরেও বাংলাদেশে পৃথিবীতে স্থান করে নিয়েছে, বাংলাভাষাকে পৃথিবীব্যাপী বিশেষভাবে চিনিয়েছে।
অনেকে বলার থাকলেও, কথা শেষ করি মাতৃভাষা কাকে বলে জেনে(আপনারা জানেন না এমন না, জানেন)। মানুষের মাতৃভাষা হলো সেটাই যে ভাষার সাথে নাড়ির যোগ আছে। বিশেষ তাৎক্ষণিক (আচমকা) যেকোনো অনুভূতিতে মন যে ভাষায় কথা বলে, মুখ বলুক না বলুক, সেটাই মাতৃভাষা। ধরুন আপনি হাঁটতে গিয়ে হোঁচট খেলেন এবং বলে উঠলেন ইসস...ওগগে মাগে ম্যইরা গেনু, সাথে আরও কিছু। তখন আপনার মা বা মা-সম কেউ যিনি শুনলেন তিনি তাঁর মাতৃত্ব মিশিয়ে যে কথাগুলো আপনারা উদ্দ্যেশ্য বলেন সেগুলোই মাতৃভাষার উদাহরণ। কিন্তু উদাহরনও এখন আর তেমন available নেই। কারণ আধুনিক শিক্ষিতা মায়েরাই আজকাল আর মাতৃভাষা চর্চা করাতে চান না, সন্তানদের জানতে দিতেও চান না। এ থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। আমরা সবই শিখবো, জানবো। কিন্তু নিজস্ব ভাষাকে ভুলে যাবো না। এই প্রতিজ্ঞা নিতে হবে। উল্লেখ্য - এদিকে থেকে বাংলাদেশের মানুষরা এগিয়ে তাঁরা তাঁদের নিজস্ব ভাষায় কথা বলতে লজ্জিত অনুভব করেন না, গর্ব করে বলেন। এটা আমাদের ও শিখতে হবে। আর এর দায়িত্ব আমাদের শিক্ষিত মানুষদের নিতে হবে। @মণি জুয়েল(ধুলিয়ানের ছেলে)
*বিপক্ষ মত, সমালোচনার মধ্যে দিয়ে পাঠক আমার এ লেখার বক্তব্য সংশোধনে সাহায্য করলে খুব ভালোলাগবে।